ঢাকা ১২:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিলিয়ে আম-কাঁঠাল যেমন পাকানো যায় না অসময়ে আন্দোলনও জমানো যায় না

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

 

গ্রামের বুড়াবুড়িরা সময়ের কাজ অসময়ে কেউ করতে দেখলে যে প্রবাদটি উচ্চারণ করেন তা হলো- বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের আম-কাঁঠাল মাঘে কিলিয়ে পাকানো যায় না। প্রবাদটি দেশের রাজনীতিতে বিরোধীদের আন্দোলনের হালচাল দেখে অনেকটাই মিল খুঁজে পেতে দেখছি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে লম্বা প্রায় দেড় বছর যুগপৎ আন্দোলনকারীরা আন্দোলন করেছে। তাতে সভা, সমাবেশ, লংমার্চ, রোডমার্চ শেষের দিকে হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ আন্দোলন, নির্বাচন বর্জন, প্রতিহত, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইন কাটা, রেলগাড়িতে অগ্নিসংযোগ, মানুষ পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি সবকিছুই করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ঠেকানো গেল না। নির্বাচনের আগেই তো আন্দোলনের একটি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ৩০-এর অধিক রাজনৈতিক দল সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে বেকায়দায় ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। সরকার উৎখাতেরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্যই থেকে গেল। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা দাবি করতে লাগলেন জনগণ তাদের কথায় আস্থা স্থাপন করে নির্বাচনে অংশ নেয়নি, ভোট দিতে যায়নি। সব দলের নেতাই বলতে থাকলেন ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও জয়লাভ করেছে বিরোধীরা, পরাজিত হয়েছে সরকার। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ডামি নির্বাচন, ভোটারবিহীন নির্বাচন ইত্যাদি নানাভাবে অভিহিত করা হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকে এখনো পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই জাতীয় প্রেস ক্লাবের আশপাশে সভা, সমাবেশ বা মিছিল করে নানা ধরনের হুংকার ও আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি আসতে যাচ্ছে- এমন কথা শোনানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে- এই নির্বাচন জনগণ মেনে নেয়নি, নেবেও না। তাই আন্দোলন করে এই সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে। সংসদ বাতিল করতেও বাধ্য করা হবে, আন্দোলন চলছে, চলবে। এমন কথা শোনার পর মনে হচ্ছে গ্রামেগঞ্জে বুড়াবুড়িদের প্রবাদটি আমাদের রাজনীতির আন্দোলনকারীরা শুনেছেন কিনা, শুনলেও এর মর্মার্থ বুঝেছেন কিনা বলা মুশকিল।

রাজনীতিতে আন্দোলন সবসময় করা যায় না। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থাকতে হয়। সময়টি যথার্থ হতে হয়। এর সবকিছু হিসাব-নিকাশ করেন আন্দোলনকারী দলগুলোর নেতারা। কখন কী কর্মসূচি দেয়া গেলে জনগণ সমর্থন দেবে, প্রয়োজনে জনগণই মাঠে নেমে আসবে। সময়টি যদি নির্ণয় করতে নেতারা ভুল করেন তাহলে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা ঘটে না। যে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা ঘটে না সেই আন্দোলন কিছুতেই সফল হয় না। সেটা অনেকটা শীতকালে গ্রীষ্মের আম-কাঁঠাল কিলিয়ে পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা হতে পারে। এখন বিএনপি কিংবা যুগপৎ আন্দোলনকারী দলের নেতারা আন্দোলন করার যেসব হুংকার দিচ্ছেন, তা যেন হুংকার হয়েই থেকে যাচ্ছে। এর থেকে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাওয়ার নয়। অসময়ে আন্দোলন করার অর্থ কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। যারা আন্দোলনের সময় যখন ছিল, তখন প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নির্ধারণ করতে পারেননি তারা কীভাবে এখন অসময়ে আন্দোলন করার কথা শোনান?

৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা মুখস্থবিদ্যায় এই নির্বাচন সম্পর্কে যেসব কথা বলছেন তার অনেকটাই বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। যদি মিল থাকত তাহলে জনগণ মাথা নেড়ে হলেও সমর্থন জানাত, আন্দোলনের ডাক ও কর্মসূচি দিলে তাতে যোগদানও করত। কিন্তু কোথাও তেমন দৃশ্য দেখা যায় না। বরং যুগপৎ আন্দোলনকারীদের মধ্যে যারা দাবি করেন যে, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জনগণ নির্বাচন বর্জন করেছে, বিরোধীরা নির্বাচনে নৈতিকভাবে জয়লাভ করেছে, সরকার পরাজিত হয়েছে- তখন বেশির ভাগ মানুষই বিরোধীদের কথায় সত্যতার অভাব দেখতে পায়। কারণ দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানুষজন ভোটও প্রদান করেছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের সঙ্গে ২০১৪ এবং ২০১৮-এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। শহরাঞ্চলে ভোটারের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম হলেও গ্রামাঞ্চলে উপস্থিতি কোথাও কোথাও বেশ চোখে পড়ার মতো ছিল। নারী ভোটারের উপস্থিতি অনেক জায়গায় প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ছিল। অনেক আসনেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে হেরেছেন তো কয়েক ডজন প্রার্থী। আবার অনেক আসনে খুব সামান্য ভোটে রক্ষা পেয়েছেন। অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাও হেরে গেছেন। এসব কি যুগপৎ আন্দোলকারী নেতারা দেখেননি? দেখলে কীভাবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এমন সব আজগুবি কথা বলতে পারেন, যা বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই। অনেকেই তাদের এই বলা কথাকে সান্তনা হিসেবে দেখছেন। বিশেষত বাম দাবিদার কিছু উগ্রবাম নেতা টিভি টকশোতে এসে যখন সেই মুখস্থবিদ্যাই ঝেরে যান, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে এসব দল এবং জোটের নেতাদের আর যাই হোক মিডিয়াগুলোতে প্রতিদিন চেহারা দেখানোর ও কথা বলার একটা সুযোগ তো ঘটেছে! সেই সুবাদে তাদের দলের নাম এবং নেতাদের নাম দর্শক-শ্রোতারা শুনতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে। অবশ্য যদি কেউ ধৈর্য ধরে একই কথা আর শুনতে চান। নির্বাচনের আগের কয়েক মাস থেকে এসব নেতার কথা টিভি টকশোতে যথেষ্ট শোনানো হয়েছে। কিন্তু তারা যা বলেছেন সেসবের কিছুই বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। তাছাড়া ২৮ অক্টোবরের ঘটনাবলি সম্পর্কে তাদের কথাবার্তায় ‘সৎ বাম রাজনীতির’ নামে সত্যকে আড়াল করা এবং শাক দিয়ে কই মাছ ঢাকার প্রবণতাই লক্ষ্য করা গেছে। এখন টিভি চ্যানেলগুলোতে তাদের চাহিদা রয়েছে, এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে যদি তারা দলের পরিচিতিটা বাড়াতে পারেন তাহলে মন্দ কি! কিন্তু তাদেরও কথাবার্তায় কোনো নতুনত্ব নেই।

আমাদের জানামতে বিপ্লবী রাজনীতিবিদরা আন্দোলন সংগ্রামের নানা চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকেন। সত্য উদঘাটনের চেষ্টার দাবি তারা করে থাকেন। কিন্তু সত্য যে বড়ই কঠিন এবং জটিলও সেটি বিপ্লবীদের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঢের পাওয়া যাবে। অনেক বাম নেতাকর্মী আন্দোলনের পর আন্দোলন করে করে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আবার অনেকে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার নামে বাম থেকে চরম ডানে জীবনের শেষ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। টিভি টকশোতে অংশ নেয়া তিন-চারজন বাম নেতার কথা শুনে মনে হয় তাদের পেছনে জনগণের সমর্থন দেশব্যাপী বুঝি ছড়িয়ে আছে। সে কারণে তারা জনগণের নাম ঘন ঘন উচ্চারণ করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন আর বামদের সুদিন নেই। সেটি তারাই অনেকটা নষ্ট করেছেন। এককালে যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে উঠতে-বসতে আটলান্টিকে নিক্ষেপ করতেন এখন সেই অভিধা নেই, বরং ‘পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বকে’ দারুণ শ্রদ্ধার চোখে তারা দেখেন। প্রতিবেশী ভারতকে দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি যে ভাষায় অভিহিত করে থাকে, তারাও কম যান না। অতিবামদের শেষ ঠিকানা শেষ পর্যন্ত অতিডানেই ঘটেছে। আওয়ামী বিদ্বেষী মনোভাব তাদের কথাবার্তায় যত প্রকাশ পায় তাতে তাদের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের চরিত্র এবং অবস্থান সহজেই নির্ণয় করা যায়।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব প্রতিদিন অনলাইনে আবির্ভূত হতেন। ইদানীং তিনি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের নতুন নতুন বার্তা দেশবাসীকে জানাচ্ছেন। তবে দেশবাসী এই মুহূর্তে আন্দোলনের মুডেই নেই, কথা শুনতেও খুব একটা প্রস্তুত আছে বলে মনে হয় না। দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সরকারই চিন্তিত সে কথা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। সরকার চেষ্টা করছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কীভাবে রোধ করা হবে তা নিয়ে। দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক তথা মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আনতে পারাটি হবে সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। মানুষ এটি এখন দেখার অপেক্ষায় আছে। আন্দোলন করে তো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাবে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পেছনে বৈশ্বিক এবং দেশীয় কারণ রয়েছে। সব কারণের সমাধান দিতে পারাটাই আসল কথা। এ ক্ষেত্রে সরকার সফল হলে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে। এর মানে এই নয় যে, দেশে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। আমরা একটি জনবহুল উন্নয়নশীল দেশ। এখানে সমস্যার অন্ত নেই। দুর্নীতি, কর্মসংস্থান, মানসম্মত শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সুশাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক কিছু করার বাকি রয়ে গেছে। সরকারের সম্মুখে সেসব চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিরোধী দল এখন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ইস্যু নিয়ে কথা বললে কোনো লাভ হবে না। একটাই করা যেতে পারে তা হলো সামনে স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচন আসছে সেসবে কীভাবে অংশ নেয়া যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। তখন হয়তো দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে পারে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলে ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত কেন নেয়া গেল না? স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সেটি হবে আরেকটি মস্ত বড় ভুল। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ার মধ্যে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নির্বাচন করার সুযোগ যেমন ঘটবে, রাজনীতিতে যে অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে তাতে কিছুটা শক্তির জোগান দেয়া যাবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারেও সময়মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার ওপর নির্ভর করে। সেই সময়টি যদি আন্দোলনকারীরা মিস করে তাহলে তারা আরো পিছিয়ে পড়বেনই। এখন বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীদেরই ভাবতে হবে তারা সময়ের কাজ সময়মতো করবেন নাকি অসময়ে আম-কাঁঠাল কিলিয়ে পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করবেন।

 

(অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারীর এ লেখাটি  ০৬ ফেব্রুয়ারি ভোরের কাগজ পত্রিকা ও ভোরের কাগজ অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত। এখনই সময়ের পাঠকদের জন্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত হলো।)

মন্তব্য লিখুন

জনপ্রিয় লেখা

কিলিয়ে আম-কাঁঠাল যেমন পাকানো যায় না অসময়ে আন্দোলনও জমানো যায় না

আপডেটের সময় ০৬:৫৪:৪১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

 

গ্রামের বুড়াবুড়িরা সময়ের কাজ অসময়ে কেউ করতে দেখলে যে প্রবাদটি উচ্চারণ করেন তা হলো- বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের আম-কাঁঠাল মাঘে কিলিয়ে পাকানো যায় না। প্রবাদটি দেশের রাজনীতিতে বিরোধীদের আন্দোলনের হালচাল দেখে অনেকটাই মিল খুঁজে পেতে দেখছি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে লম্বা প্রায় দেড় বছর যুগপৎ আন্দোলনকারীরা আন্দোলন করেছে। তাতে সভা, সমাবেশ, লংমার্চ, রোডমার্চ শেষের দিকে হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ আন্দোলন, নির্বাচন বর্জন, প্রতিহত, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইন কাটা, রেলগাড়িতে অগ্নিসংযোগ, মানুষ পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি সবকিছুই করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ঠেকানো গেল না। নির্বাচনের আগেই তো আন্দোলনের একটি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ৩০-এর অধিক রাজনৈতিক দল সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে বেকায়দায় ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। সরকার উৎখাতেরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্যই থেকে গেল। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা দাবি করতে লাগলেন জনগণ তাদের কথায় আস্থা স্থাপন করে নির্বাচনে অংশ নেয়নি, ভোট দিতে যায়নি। সব দলের নেতাই বলতে থাকলেন ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও জয়লাভ করেছে বিরোধীরা, পরাজিত হয়েছে সরকার। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ডামি নির্বাচন, ভোটারবিহীন নির্বাচন ইত্যাদি নানাভাবে অভিহিত করা হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকে এখনো পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই জাতীয় প্রেস ক্লাবের আশপাশে সভা, সমাবেশ বা মিছিল করে নানা ধরনের হুংকার ও আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি আসতে যাচ্ছে- এমন কথা শোনানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে- এই নির্বাচন জনগণ মেনে নেয়নি, নেবেও না। তাই আন্দোলন করে এই সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে। সংসদ বাতিল করতেও বাধ্য করা হবে, আন্দোলন চলছে, চলবে। এমন কথা শোনার পর মনে হচ্ছে গ্রামেগঞ্জে বুড়াবুড়িদের প্রবাদটি আমাদের রাজনীতির আন্দোলনকারীরা শুনেছেন কিনা, শুনলেও এর মর্মার্থ বুঝেছেন কিনা বলা মুশকিল।

রাজনীতিতে আন্দোলন সবসময় করা যায় না। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থাকতে হয়। সময়টি যথার্থ হতে হয়। এর সবকিছু হিসাব-নিকাশ করেন আন্দোলনকারী দলগুলোর নেতারা। কখন কী কর্মসূচি দেয়া গেলে জনগণ সমর্থন দেবে, প্রয়োজনে জনগণই মাঠে নেমে আসবে। সময়টি যদি নির্ণয় করতে নেতারা ভুল করেন তাহলে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা ঘটে না। যে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা ঘটে না সেই আন্দোলন কিছুতেই সফল হয় না। সেটা অনেকটা শীতকালে গ্রীষ্মের আম-কাঁঠাল কিলিয়ে পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা হতে পারে। এখন বিএনপি কিংবা যুগপৎ আন্দোলনকারী দলের নেতারা আন্দোলন করার যেসব হুংকার দিচ্ছেন, তা যেন হুংকার হয়েই থেকে যাচ্ছে। এর থেকে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাওয়ার নয়। অসময়ে আন্দোলন করার অর্থ কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। যারা আন্দোলনের সময় যখন ছিল, তখন প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নির্ধারণ করতে পারেননি তারা কীভাবে এখন অসময়ে আন্দোলন করার কথা শোনান?

৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা মুখস্থবিদ্যায় এই নির্বাচন সম্পর্কে যেসব কথা বলছেন তার অনেকটাই বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। যদি মিল থাকত তাহলে জনগণ মাথা নেড়ে হলেও সমর্থন জানাত, আন্দোলনের ডাক ও কর্মসূচি দিলে তাতে যোগদানও করত। কিন্তু কোথাও তেমন দৃশ্য দেখা যায় না। বরং যুগপৎ আন্দোলনকারীদের মধ্যে যারা দাবি করেন যে, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জনগণ নির্বাচন বর্জন করেছে, বিরোধীরা নির্বাচনে নৈতিকভাবে জয়লাভ করেছে, সরকার পরাজিত হয়েছে- তখন বেশির ভাগ মানুষই বিরোধীদের কথায় সত্যতার অভাব দেখতে পায়। কারণ দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানুষজন ভোটও প্রদান করেছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের সঙ্গে ২০১৪ এবং ২০১৮-এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। শহরাঞ্চলে ভোটারের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম হলেও গ্রামাঞ্চলে উপস্থিতি কোথাও কোথাও বেশ চোখে পড়ার মতো ছিল। নারী ভোটারের উপস্থিতি অনেক জায়গায় প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ছিল। অনেক আসনেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে হেরেছেন তো কয়েক ডজন প্রার্থী। আবার অনেক আসনে খুব সামান্য ভোটে রক্ষা পেয়েছেন। অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাও হেরে গেছেন। এসব কি যুগপৎ আন্দোলকারী নেতারা দেখেননি? দেখলে কীভাবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এমন সব আজগুবি কথা বলতে পারেন, যা বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই। অনেকেই তাদের এই বলা কথাকে সান্তনা হিসেবে দেখছেন। বিশেষত বাম দাবিদার কিছু উগ্রবাম নেতা টিভি টকশোতে এসে যখন সেই মুখস্থবিদ্যাই ঝেরে যান, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে এসব দল এবং জোটের নেতাদের আর যাই হোক মিডিয়াগুলোতে প্রতিদিন চেহারা দেখানোর ও কথা বলার একটা সুযোগ তো ঘটেছে! সেই সুবাদে তাদের দলের নাম এবং নেতাদের নাম দর্শক-শ্রোতারা শুনতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে। অবশ্য যদি কেউ ধৈর্য ধরে একই কথা আর শুনতে চান। নির্বাচনের আগের কয়েক মাস থেকে এসব নেতার কথা টিভি টকশোতে যথেষ্ট শোনানো হয়েছে। কিন্তু তারা যা বলেছেন সেসবের কিছুই বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। তাছাড়া ২৮ অক্টোবরের ঘটনাবলি সম্পর্কে তাদের কথাবার্তায় ‘সৎ বাম রাজনীতির’ নামে সত্যকে আড়াল করা এবং শাক দিয়ে কই মাছ ঢাকার প্রবণতাই লক্ষ্য করা গেছে। এখন টিভি চ্যানেলগুলোতে তাদের চাহিদা রয়েছে, এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে যদি তারা দলের পরিচিতিটা বাড়াতে পারেন তাহলে মন্দ কি! কিন্তু তাদেরও কথাবার্তায় কোনো নতুনত্ব নেই।

আমাদের জানামতে বিপ্লবী রাজনীতিবিদরা আন্দোলন সংগ্রামের নানা চুলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকেন। সত্য উদঘাটনের চেষ্টার দাবি তারা করে থাকেন। কিন্তু সত্য যে বড়ই কঠিন এবং জটিলও সেটি বিপ্লবীদের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঢের পাওয়া যাবে। অনেক বাম নেতাকর্মী আন্দোলনের পর আন্দোলন করে করে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আবার অনেকে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার নামে বাম থেকে চরম ডানে জীবনের শেষ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। টিভি টকশোতে অংশ নেয়া তিন-চারজন বাম নেতার কথা শুনে মনে হয় তাদের পেছনে জনগণের সমর্থন দেশব্যাপী বুঝি ছড়িয়ে আছে। সে কারণে তারা জনগণের নাম ঘন ঘন উচ্চারণ করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন আর বামদের সুদিন নেই। সেটি তারাই অনেকটা নষ্ট করেছেন। এককালে যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে উঠতে-বসতে আটলান্টিকে নিক্ষেপ করতেন এখন সেই অভিধা নেই, বরং ‘পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বকে’ দারুণ শ্রদ্ধার চোখে তারা দেখেন। প্রতিবেশী ভারতকে দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি যে ভাষায় অভিহিত করে থাকে, তারাও কম যান না। অতিবামদের শেষ ঠিকানা শেষ পর্যন্ত অতিডানেই ঘটেছে। আওয়ামী বিদ্বেষী মনোভাব তাদের কথাবার্তায় যত প্রকাশ পায় তাতে তাদের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের চরিত্র এবং অবস্থান সহজেই নির্ণয় করা যায়।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব প্রতিদিন অনলাইনে আবির্ভূত হতেন। ইদানীং তিনি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের নতুন নতুন বার্তা দেশবাসীকে জানাচ্ছেন। তবে দেশবাসী এই মুহূর্তে আন্দোলনের মুডেই নেই, কথা শুনতেও খুব একটা প্রস্তুত আছে বলে মনে হয় না। দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সরকারই চিন্তিত সে কথা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। সরকার চেষ্টা করছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কীভাবে রোধ করা হবে তা নিয়ে। দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক তথা মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আনতে পারাটি হবে সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। মানুষ এটি এখন দেখার অপেক্ষায় আছে। আন্দোলন করে তো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাবে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পেছনে বৈশ্বিক এবং দেশীয় কারণ রয়েছে। সব কারণের সমাধান দিতে পারাটাই আসল কথা। এ ক্ষেত্রে সরকার সফল হলে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে। এর মানে এই নয় যে, দেশে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। আমরা একটি জনবহুল উন্নয়নশীল দেশ। এখানে সমস্যার অন্ত নেই। দুর্নীতি, কর্মসংস্থান, মানসম্মত শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সুশাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক কিছু করার বাকি রয়ে গেছে। সরকারের সম্মুখে সেসব চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। বিরোধী দল এখন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ইস্যু নিয়ে কথা বললে কোনো লাভ হবে না। একটাই করা যেতে পারে তা হলো সামনে স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচন আসছে সেসবে কীভাবে অংশ নেয়া যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। তখন হয়তো দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে পারে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলে ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত কেন নেয়া গেল না? স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সেটি হবে আরেকটি মস্ত বড় ভুল। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ার মধ্যে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নির্বাচন করার সুযোগ যেমন ঘটবে, রাজনীতিতে যে অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে তাতে কিছুটা শক্তির জোগান দেয়া যাবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারেও সময়মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার ওপর নির্ভর করে। সেই সময়টি যদি আন্দোলনকারীরা মিস করে তাহলে তারা আরো পিছিয়ে পড়বেনই। এখন বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীদেরই ভাবতে হবে তারা সময়ের কাজ সময়মতো করবেন নাকি অসময়ে আম-কাঁঠাল কিলিয়ে পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করবেন।

 

(অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারীর এ লেখাটি  ০৬ ফেব্রুয়ারি ভোরের কাগজ পত্রিকা ও ভোরের কাগজ অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত। এখনই সময়ের পাঠকদের জন্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত হলো।)