ঢাকা ০১:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান

ড. মো. মোরশেদুল আলম

 

ভূকৌশলগত কারণে মিয়ানমারের রাখাইন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর, গ্যাস পাইপলাইন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে চীন কয়েক শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্টের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, জ্বালানি খাত, জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র পুনর্বাসন প্রকল্প ও যোগাযোগ খাতে আর্থিকভাবে বিনিয়োগ করছে জাপান। মূলত চীন, ভারত ও রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষাকারী মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রতি অন্য কোনো দেশের সমর্থন নেই বললেই চলে। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীন ও ভারত যেমন, তেমনি বার্মা অ্যাক্টের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র।

সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনার স্বরূপ বিশ্লেষণ জরুরি। বাংলাদেশের নিরাপত্তার কারণেই তা একান্ত আবশ্যক। আমরা জানি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও আরাকান আর্মি মিলে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠন করে। বর্তমানে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোর (ইএও) সমন্বিত আক্রমণে পর্যুদস্ত। ফলে জান্তা সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত অক্টোবরে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) দেশের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দাবি করছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ২৭ অক্টোবর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অনেকগুলো সেনাঘাঁটি এবং বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নিয়েছে। এই সমন্বিত আক্রমণে চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য রুট এবং বাণিজ্য ক্রসিং পোস্টগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগসহ বেশ কয়েকটি টাউনশিপ ইএওর দখলে এসেছে। মিয়ানমারে প্রতিরোধযোদ্ধারা ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন ভুলে সবাই একসঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করছে। মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা মিলে জান্তার বিরুদ্ধে চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ) একত্রে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। জান্তাপ্রধান মিন অন হ্লাইং বৌদ্ধধর্মের রক্ষক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করলেও বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক পটভূমির যুবকেরা প্রতিরোধগোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন। তারা একটি আদর্শ মিয়ানমার রাষ্ট্র চান, যেখানে সব জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমান আচরণ, কথা বলার স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ থাকবে। মিয়ানমারের ভিক্ষুরা এখন সামরিক শাসন সমর্থন করেন না।

সামরিক জান্তা বর্তমানে দেশের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধরত ইএওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে রাখাইনে অবরোধ আরোপ করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তার অবরোধের ফলে বাসিন্দারা ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে এবং রাজ্যের ভেতরে ও বাইরে সব রাস্তা ও জলপথে অবরোধ আরোপ করার ফলে খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য মৌলিক সামগ্রীর অভাবে জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। আরাকান আর্মি (এএ) ও রাখাইনের জনগণ জান্তার ‘ফোর কাট স্ট্র্যাটেজি’র কারণে মানবিক সংকটে রয়েছে। ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা চাইছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডিফেন্সের সঙ্গে আরাকান আর্মির তেমন কোনো যোগসূত্র নেই। তাদের যোগসূত্র আছে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, শান, তাং বা ওয়া আর্মির সঙ্গে। এরা আবার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের সঙ্গে তেমনভাবে সংশ্লিষ্ট নয়। বর্তমানে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স বা ফ্রেন্ডশিপ অ্যালায়েন্স চীনের আশীর্বাদপুষ্ট। এখানে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আবার চীনের আশীর্বাদপুষ্ট। বরং এটি চীনের একটি কৌশল।

২০১৩ সালে চীনের বিশ্বব্যাপী নতুন ভূকৌশলগত পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের তীরে রাখাইন অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের অন্যতম শত্রু রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের স্থল সীমান্ত সংযোগ রয়েছে। মিয়ানমারে ভারতের প্রভাব হ্রাস, ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলা এবং যে কোনো মূল্যে মিয়ানমারকে হাতে রাখা চীনের অন্যতম সামরিক কৌশল। রাখাইনের আকিয়াব সমুদ্রবন্দরে চীনের জ্বালানি তেলের টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে; যার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তেল আমদানিতে মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা হ্রাস এবং ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের সামরিক শক্তির আধিপত্যকে জানান দেওয়া। এজন্য চীন মিয়ানমারের কাছ থেকে নিজ স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া। চীন অবরোধের চার দশক ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছে সব ধরনের অস্ত্রের প্রায় একক বিক্রেতা। চীনের নির্মিত অস্ত্রই মিয়ানমার প্রতিরক্ষা খাতের প্রধান শক্তি। সুতরাং এত বড় অস্ত্রের বাজার চীন কখনোই হাতছাড়া করতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া চীনের বিরুদ্ধে এর সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের কাচিন, সান, কোকাং অঞ্চলসহ কয়েকটি রাজ্য ও এলাকায় স্বাধীনতাকামীদের অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমারকে বশে রাখতেই চীন এমন দ্বিমুখী কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।

ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতও মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন দমন, করিডর সুবিধা, ট্রান্সশিপমেন্ট প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা হলেও মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনরত তিনটি রাজ্য মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের বিদ্রোহ দমন করতে মিয়ানমারের সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনরত সাতটি রাজ্য ‘সেভেন সিস্টার্স’-এ পণ্য পরিবহন, সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো ও সড়ক যোগাযোগের একমাত্র স্থলপথ ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের শিলিগুড়ি করিডর। চীন-ভারত যুদ্ধ হলেই এই করিডর দখল করে নিতে চীন চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন ট্রানজিটও যদি ব্যবহার করতে না পারে, তবে ভারতের পক্ষে সেভেন সিস্টার্সের নিয়ন্ত্রণ হারানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই বিকল্প হিসেবে ভারত মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে কালাদান নদী ব্যবহার করে রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের মধ্য দিয়ে লম্বা একটি ‘মাল্টিমোড আল’ বা বহুমাত্রিক যোগাযোগ স্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা কালাদান মাল্টিমোডা ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট নামে পরিচিত। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, চীন ভারতকে গিলে ফেলেছে। তাই নিরাপত্তা ও সামরিক কৌশলগত কারণে মিয়ানমারে চীনের আধিপত্য কমাতে ভারত তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ‘অ্যাক্ট ইস্ট প্রকল্প’-এর আওতায় ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড যোগোযোগ স্থাপনের কাজও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। তাছাড়া ভারত কিছু সমরাস্ত্র তৈরি করেছে। অস্ত্র বিক্রির বাজারের খোঁজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, সেনা-নৌবাহিনীর প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার সফর করেছেন।

ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার শাসনভার গ্রহণের পর দেশটি মিয়ানমারমুখী হয়েছে। রাশিয়ার সরকার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ২০১৫ সালে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক অবরোধ উঠে গেলে রাশিয়া দেশটিতে বিনিয়োগ ও অস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঐ বছরই ৩০ বছর যাবত্ মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজারে চীনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রাশিয়া ভাগ বসায়। সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ, নবপ্রযুক্তি ও প্রজন্মের অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধকরণ এবং বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাধীনতাকামী আন্দোলন দমাতে বিমান বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া ইত্যাদি কারণেই মিয়ানমার রাশিয়ার অস্ত্রের প্রতি মনোযোগ দেয়। এই অবস্থান একচেটিয়া করতেই রাশিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাশিয়া শুধু মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজারের দিকেই নজর দিয়েছে এমন নয়, বরং বিনিয়োগে অর্থসহায়তা এবং প্রযুক্তি রপ্তানির দিকেও বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। এ লক্ষ্যে রাশিয়া মিয়ানমারের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র তৈরির চুক্তি করে ২০১৩ সালে, যার কাজ এরই মধ্যে চলছে। এছাড়া দেশটির বিপুল খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে তেল ও গ্যাস আহরণে রাশিয়া এরই মধ্যে মিয়ানমারে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। তাই রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রতিযোগিতায় রাশিয়া কিছুতেই পিছিয়ে পড়তে চাইবে না।

এক তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে শতাব্দী ধরে চলা এই সংঘাতকে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক খেলুড়েরা। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় এলাকায় হাইড্রোকার্বনের বিপুল রিজার্ভের দিকে তাদের দৃষ্টি রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। মোসিয়াকভ মনে করেন, বিশ্বের কিছু প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতির দেশ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায় মদদ দিয়ে সেই সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরতে চায়। আঞ্চলিক সংঘাত উসকে দিয়ে সার্বভৌমত্বের দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও চাপ তৈরি করতে চায়।

সেনা অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোসহ বেশ কিছু দেশ জান্তানিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ইইউ মিয়ানমারে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ, জান্তা কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, ভিসা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। তবে মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব এবং বিদেশি বিনিয়োগের ওপর ভর করে সামরিক জান্তা পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্ব না দিয়েও চলতে পারছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান, সৌদি আরব এমনকি তুরস্কেরও সম্পৃক্ততা ও স্বার্থ রয়েছে।

বিশেষ করে, আরাকানে ভূরাজনৈতিক কৌশল ও ভূরাজনৈতিক অর্থনীতিবিষয়ক বিপুল স্বার্থ রয়েছে চীন ও ভারতের। সেটার ওপর পারস্পরিক আঘাত হানার প্রচেষ্টা থেকে এই যুদ্ধ চলছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। মিয়ানমারের চলমান উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতা প্রতিবেশীসহ আঞ্চলিক হুমকি সৃষ্টি করলেও এখনো কোনো ধরনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। মিয়নমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের প্রভাবে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। মিয়ানমারের চলমান সংঘাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সে দেশে দ্রুততম সময়ে ফেরত পাঠানো হবে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এখানে সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরিন বলেন, আশা করা হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে, সেটা আকাশপথেই হোক বা সমুদ্রপথেই হোক। নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জরুরি।’

 

(প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ড. মো. মোরশেদুল আলম এর লেখা এ কলামটি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় আজ ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত। এখনই সময়ের পাঠকের জন্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো।)

মন্তব্য লিখুন

জনপ্রিয় লেখা

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান

আপডেটের সময় ০৪:০১:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

ড. মো. মোরশেদুল আলম

 

ভূকৌশলগত কারণে মিয়ানমারের রাখাইন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর, গ্যাস পাইপলাইন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে চীন কয়েক শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্টের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, জ্বালানি খাত, জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র পুনর্বাসন প্রকল্প ও যোগাযোগ খাতে আর্থিকভাবে বিনিয়োগ করছে জাপান। মূলত চীন, ভারত ও রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষাকারী মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রতি অন্য কোনো দেশের সমর্থন নেই বললেই চলে। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীন ও ভারত যেমন, তেমনি বার্মা অ্যাক্টের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র।

সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনার স্বরূপ বিশ্লেষণ জরুরি। বাংলাদেশের নিরাপত্তার কারণেই তা একান্ত আবশ্যক। আমরা জানি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও আরাকান আর্মি মিলে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠন করে। বর্তমানে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোর (ইএও) সমন্বিত আক্রমণে পর্যুদস্ত। ফলে জান্তা সরকার দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত অক্টোবরে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) দেশের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দাবি করছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ২৭ অক্টোবর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অনেকগুলো সেনাঘাঁটি এবং বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নিয়েছে। এই সমন্বিত আক্রমণে চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য রুট এবং বাণিজ্য ক্রসিং পোস্টগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগসহ বেশ কয়েকটি টাউনশিপ ইএওর দখলে এসেছে। মিয়ানমারে প্রতিরোধযোদ্ধারা ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন ভুলে সবাই একসঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করছে। মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা মিলে জান্তার বিরুদ্ধে চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ) একত্রে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। জান্তাপ্রধান মিন অন হ্লাইং বৌদ্ধধর্মের রক্ষক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করলেও বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক পটভূমির যুবকেরা প্রতিরোধগোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন। তারা একটি আদর্শ মিয়ানমার রাষ্ট্র চান, যেখানে সব জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমান আচরণ, কথা বলার স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ থাকবে। মিয়ানমারের ভিক্ষুরা এখন সামরিক শাসন সমর্থন করেন না।

সামরিক জান্তা বর্তমানে দেশের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধরত ইএওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে রাখাইনে অবরোধ আরোপ করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তার অবরোধের ফলে বাসিন্দারা ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে এবং রাজ্যের ভেতরে ও বাইরে সব রাস্তা ও জলপথে অবরোধ আরোপ করার ফলে খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য মৌলিক সামগ্রীর অভাবে জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। আরাকান আর্মি (এএ) ও রাখাইনের জনগণ জান্তার ‘ফোর কাট স্ট্র্যাটেজি’র কারণে মানবিক সংকটে রয়েছে। ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা চাইছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডিফেন্সের সঙ্গে আরাকান আর্মির তেমন কোনো যোগসূত্র নেই। তাদের যোগসূত্র আছে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, শান, তাং বা ওয়া আর্মির সঙ্গে। এরা আবার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের সঙ্গে তেমনভাবে সংশ্লিষ্ট নয়। বর্তমানে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স বা ফ্রেন্ডশিপ অ্যালায়েন্স চীনের আশীর্বাদপুষ্ট। এখানে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আবার চীনের আশীর্বাদপুষ্ট। বরং এটি চীনের একটি কৌশল।

২০১৩ সালে চীনের বিশ্বব্যাপী নতুন ভূকৌশলগত পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের তীরে রাখাইন অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের অন্যতম শত্রু রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের স্থল সীমান্ত সংযোগ রয়েছে। মিয়ানমারে ভারতের প্রভাব হ্রাস, ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলা এবং যে কোনো মূল্যে মিয়ানমারকে হাতে রাখা চীনের অন্যতম সামরিক কৌশল। রাখাইনের আকিয়াব সমুদ্রবন্দরে চীনের জ্বালানি তেলের টার্মিনাল তৈরি হচ্ছে; যার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তেল আমদানিতে মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা হ্রাস এবং ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের সামরিক শক্তির আধিপত্যকে জানান দেওয়া। এজন্য চীন মিয়ানমারের কাছ থেকে নিজ স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া। চীন অবরোধের চার দশক ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছে সব ধরনের অস্ত্রের প্রায় একক বিক্রেতা। চীনের নির্মিত অস্ত্রই মিয়ানমার প্রতিরক্ষা খাতের প্রধান শক্তি। সুতরাং এত বড় অস্ত্রের বাজার চীন কখনোই হাতছাড়া করতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া চীনের বিরুদ্ধে এর সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের কাচিন, সান, কোকাং অঞ্চলসহ কয়েকটি রাজ্য ও এলাকায় স্বাধীনতাকামীদের অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমারকে বশে রাখতেই চীন এমন দ্বিমুখী কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।

ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতও মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন দমন, করিডর সুবিধা, ট্রান্সশিপমেন্ট প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা হলেও মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনরত তিনটি রাজ্য মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের বিদ্রোহ দমন করতে মিয়ানমারের সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনরত সাতটি রাজ্য ‘সেভেন সিস্টার্স’-এ পণ্য পরিবহন, সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো ও সড়ক যোগাযোগের একমাত্র স্থলপথ ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের শিলিগুড়ি করিডর। চীন-ভারত যুদ্ধ হলেই এই করিডর দখল করে নিতে চীন চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন ট্রানজিটও যদি ব্যবহার করতে না পারে, তবে ভারতের পক্ষে সেভেন সিস্টার্সের নিয়ন্ত্রণ হারানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই বিকল্প হিসেবে ভারত মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে কালাদান নদী ব্যবহার করে রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের মধ্য দিয়ে লম্বা একটি ‘মাল্টিমোড আল’ বা বহুমাত্রিক যোগাযোগ স্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা কালাদান মাল্টিমোডা ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট নামে পরিচিত। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, চীন ভারতকে গিলে ফেলেছে। তাই নিরাপত্তা ও সামরিক কৌশলগত কারণে মিয়ানমারে চীনের আধিপত্য কমাতে ভারত তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ‘অ্যাক্ট ইস্ট প্রকল্প’-এর আওতায় ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড যোগোযোগ স্থাপনের কাজও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। তাছাড়া ভারত কিছু সমরাস্ত্র তৈরি করেছে। অস্ত্র বিক্রির বাজারের খোঁজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, সেনা-নৌবাহিনীর প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার সফর করেছেন।

ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার শাসনভার গ্রহণের পর দেশটি মিয়ানমারমুখী হয়েছে। রাশিয়ার সরকার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ২০১৫ সালে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক অবরোধ উঠে গেলে রাশিয়া দেশটিতে বিনিয়োগ ও অস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঐ বছরই ৩০ বছর যাবত্ মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজারে চীনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রাশিয়া ভাগ বসায়। সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ, নবপ্রযুক্তি ও প্রজন্মের অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধকরণ এবং বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাধীনতাকামী আন্দোলন দমাতে বিমান বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া ইত্যাদি কারণেই মিয়ানমার রাশিয়ার অস্ত্রের প্রতি মনোযোগ দেয়। এই অবস্থান একচেটিয়া করতেই রাশিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাশিয়া শুধু মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজারের দিকেই নজর দিয়েছে এমন নয়, বরং বিনিয়োগে অর্থসহায়তা এবং প্রযুক্তি রপ্তানির দিকেও বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। এ লক্ষ্যে রাশিয়া মিয়ানমারের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র তৈরির চুক্তি করে ২০১৩ সালে, যার কাজ এরই মধ্যে চলছে। এছাড়া দেশটির বিপুল খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে তেল ও গ্যাস আহরণে রাশিয়া এরই মধ্যে মিয়ানমারে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। তাই রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রতিযোগিতায় রাশিয়া কিছুতেই পিছিয়ে পড়তে চাইবে না।

এক তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে শতাব্দী ধরে চলা এই সংঘাতকে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক খেলুড়েরা। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় এলাকায় হাইড্রোকার্বনের বিপুল রিজার্ভের দিকে তাদের দৃষ্টি রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। মোসিয়াকভ মনে করেন, বিশ্বের কিছু প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতির দেশ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায় মদদ দিয়ে সেই সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরতে চায়। আঞ্চলিক সংঘাত উসকে দিয়ে সার্বভৌমত্বের দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও চাপ তৈরি করতে চায়।

সেনা অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোসহ বেশ কিছু দেশ জান্তানিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ইইউ মিয়ানমারে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ, জান্তা কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, ভিসা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। তবে মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব এবং বিদেশি বিনিয়োগের ওপর ভর করে সামরিক জান্তা পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্ব না দিয়েও চলতে পারছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান, সৌদি আরব এমনকি তুরস্কেরও সম্পৃক্ততা ও স্বার্থ রয়েছে।

বিশেষ করে, আরাকানে ভূরাজনৈতিক কৌশল ও ভূরাজনৈতিক অর্থনীতিবিষয়ক বিপুল স্বার্থ রয়েছে চীন ও ভারতের। সেটার ওপর পারস্পরিক আঘাত হানার প্রচেষ্টা থেকে এই যুদ্ধ চলছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। মিয়ানমারের চলমান উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতা প্রতিবেশীসহ আঞ্চলিক হুমকি সৃষ্টি করলেও এখনো কোনো ধরনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। মিয়নমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের প্রভাবে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। মিয়ানমারের চলমান সংঘাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সে দেশে দ্রুততম সময়ে ফেরত পাঠানো হবে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এখানে সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরিন বলেন, আশা করা হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে, সেটা আকাশপথেই হোক বা সমুদ্রপথেই হোক। নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জরুরি।’

 

(প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ড. মো. মোরশেদুল আলম এর লেখা এ কলামটি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় আজ ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত। এখনই সময়ের পাঠকের জন্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো।)