ঢাকা ০১:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকা-ইসলামাবাদে হাস-ব্লু দিল্লিতে বেখবর এরিক

সাংবাদিক কলামিস্ট মোস্তফা কামাল

মোস্তফা কামাল

 

নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় পিটার ডি হাসের মতো না হলেও ইসলামাবাদে ক’দিন ধরে কর্মব্যস্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড ব্লুম। পাকিস্তানে ব্লু নামে বেশ পরিচিত তিনি। তবে, গণমাধ্যমে সংক্ষেপে ব্লুম। তার দেখাদেখি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের মধ্যেও পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে ব্যতিব্যস্ততায় বাড়বাড়ন্ত। বৈঠকসহ আতিথেয়তা নিচ্ছেন নেতাদের। দিচ্ছেনও। পাকিস্তানের পিএমএল-এনের শীর্ষ নেতা নওয়াজ শরীফের সঙ্গে লাহোরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড  ব্লুর সাম্প্রতিক বৈঠক দেশটিতে বেশ আলোচিত। গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে নওয়াজের দলের প্রস্তুতি এবং দেশটির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-পিএমএল-এন এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের আলোচনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের গুরুত্ব বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। নমুনা বা সিলসিলা বাংলাদেশের মতোই। যা হয়েছে ঢাকায় হাস ও বিভিন্ন দলের মধ্যে। বাংলাদেশে হাস-পর্বে এখন একটি কমা বা সেমিকোলন চলছে। ফুলস্টপ নয়। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ‘দিল্লি আছে আমরা আছি; আমেরিকার ভারতকে দরকার; তলে তলে পিটার হাসের মুরব্বিদের সঙ্গে আপস হয়ে গেছে’ এ বার্তার পর বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা হয়েছে। আলোচনাটি দৃশ্যত এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনুকূলে। নয়াদিল্লিতে দুদেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী টু প্লাস টু ডায়ালগের পর আলাদা ব্রিফিং করেন ভারতের বিদেশ সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ বিষয় অনুপস্থিত থাকলেও পরে কথা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে নয়াদিল্লির বক্তব্যের জবাবে ওয়াশিংটন কী বলেছিল তার কিছুটা আভাস মিলছে যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের রিপোর্টে। ১৭ নভেম্বর প্রকাশিত ওই রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়। জানা যাচ্ছে, ডায়ালগে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হয়। বৈঠকে আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা হয়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ভারতও জানিয়েছে, তারা প্রগতির বাংলাদেশ চায়।

 

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে রাজনৈতিক দলের বাইরেও সোচ্চার আছে বিশ্বের অনেক প্রভাশালী দেশ ও সংগঠন। বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কড়া নজরদারিতে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ঠিক তফসিল ঘোষণার আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে এশিয়া সাব-কন্টিনেন্টে প্রভাবশালী ডোনাল্ড লু’র চিঠিও আরেক কূটনীতি। যার সঙ্গে পাকিস্তানের ইমরান খানের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে মেলানোর একটি চর্চা চলছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে কলকাঠি নাড়ার ম্যাকানিজমে তিনি বেশ আলোচিত। সেখানে উদাহরণ হিসেবে আনা হয় ইমরান খানের পতনকে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ বা খানের সঙ্গে শেখকে মেলানোর বাস্তবতা নেই। এরপরও ইমরান খান নিজেই ডোনাল্ড লুর কারণেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে মন্তব্য করায় একটি তুলনা টানার চেষ্টা রয়েছে। কিছু জিজ্ঞাসাও ঘুরছে। একেবারেই শেষ পর্যায়ে কেন চিঠিটি দিলেন ডোনাল্ড লু? এ প্রশ্ন অগ্রাহ্য করা যায় না। চাইলে চিঠিটি কি মাসখানেক বা অন্তত ১৫ দিন আগেও দিতে পারতেন না? তা না করে কি সরকারকে বিকল্প চিন্তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলো না? নমুনাগতভাবে এতে পাকিস্তানের ছাপ।

 

অর্থনৈতিকসহ নানা সংকটে পড়া পাকিস্তান দেউলিয়াত্ব ঠেকাতে বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে বছরখানেক ধরে। খরচ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কার্যকরী মেনে এগোচ্ছে দেশটি। সরকারি অফিসে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপের পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে বিপণি বিতান বন্ধ, বিয়েসহ অন্য অনুষ্ঠানগুলো বেঁধে দেওয়া সময়ে শেষ করতে নির্দেশনা দিয়েছে শাহবাজ শরিফের মন্ত্রিসভা। এর মাধ্যমে যেন বাংলাদেশকেই মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে পাাকিস্তান। পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মতো বানাও আওয়াজ আছে দেশটির সুশীল সমাজের। সেখানে এখন লু হাওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানের রাজনীতির দিকে টেনে নেওয়ার কূটনীতির চক্কর। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক টানাপড়েনে যাচ্ছে পাকিস্তান। টানাপড়েন চলছে বাংলাদেশেও। কিন্তু, রকমফেরও বিস্তর।

 

পাকিস্তানে পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া বিপুল ঋণ নিয়ে মসনদে আসেন ইমরান খান। সৌদি আরব এবং চীনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে কোনোভাবে পাকিস্তানকে টেনে নিচ্ছিলেন। তবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তিনিও থিতু হতে পারেননি। ইমরানকে সরিয়ে গত এপ্রিলে ক্ষমতায় আসেন নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফ। তখন পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ৭ মাসে তা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। দেউলিয়ার আশঙ্কা যে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না তা ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির দর দেখেই অনুমান করা যায়। এপ্রিলে এক ডলার বিক্রি হতো ১৮০ রুপিতে। হালে আন্তঃব্যাংক বাজারে তা ঠেকেছে ২২৬। এসব সূচকে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কাতারে বিচার করা যায় না।

 

স্বাধীনতার পর প্রায় শূন্য থেকে শুরু করলেও ৫০ বছরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের সেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন এবং সৌদি আরবও এখন আর তাদের দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। পাকিস্তানের বিদ্যুৎব্যবস্থা ভয়ানক, লোডশেডিংসহ প্রায়ই গ্রিড-ফেইলিউরের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে তা ওই পর্যায়ে নয়। দুর্নীতি, পাচার, দলীয় দুর্বৃত্তায়ন বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের কাছে অনুকরণীয়। কিন্তু, রাজনীতির লু হাওয়া এখন বাংলাদেশকে পেছন থেকে টানছে পাকিস্তানের দিকে। ভূ-রাজনীতিসহ আরও কিছু বিষয় বাংলাদেশকে একদম পেয়ে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন-ভিসা রেস্ট্রিকশনের পর বিভিন্ন দেশের শ্রম অধিকার নিশ্চিতে নতুন নীতি ঘোষণা করেছে। এজন্য নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ভিসা বাধাসহ তাদের যেসব উপায় আছে সেগুলো ব্যবহারের ঘোষণা করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের উদাহরণ সরাসরি টেনে এনেছেন। ডোনাল্ড লুর চিঠিকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচন সিডিউল ঘোষণা করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার একটা শঙ্কা এমনিতেই ঘুরছিল।

 

মার্কিন পলিসি মেকাররা নিয়মতান্ত্রিক আশাবাদের আবাদ করে না। তারা প্রয়োগের জন্য পলিসি বানায়। তারা সরকারের কাছে এমন জিনিসই চেয়েছে যা দিলে সরকার আর থাকে না। গণতন্ত্রায়ন আশা করে তারা। সেইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনও চায়। যা দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। আবার সরকার প্রকাশ্যে রাগও করে না। ‘নির্বাচন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ মর্মে কথাও বাতলে দেয়। কিন্তু, ভেতরে ভেতরে ফোঁসে। নানা প্ল্যান করে। তাদের ‘এ’ ব্যর্থ হলে ‘বি’। ‘বি’ ব্যর্থ হলে ‘সি’-এর মতো, ব্যাকআপ থাকেই। প্রয়োজন মতো সেগুলো প্রয়োগ করে। তা মালুম না করে পিটার হাস চলে গেছেন বলে একদল উল্লাসে মাতে। পিটারকে পেটানো, হাসকে জবাই করে খাওয়ার হুঙ্কারদাতা মহলের বিপরীতে আরেক দলের আশা পিটার হাস তাদের ভগবান হবেন। পিটার হাস ঢাকা ছেড়ে গেছেন মানে চলে যাননি। তিনি হোস্ট কান্ট্রিতে অ্যাসাইনমেন্ট ফেল করেছেন এমন মেসেজও মেলেনি। বা তিনি ফেল করলেও তার দেশ ফেল করেছে মনে করার সময় এখনো আসেনি। বাংলাদেশ পিটার হাসদের আদর-সমাদরের লীলাভূমি। পাকিস্তানও তাই। কিন্তু, প্রতিবেশী ভারত? সেখানে কি হাস, বিউটিনিস, মজিনা, বার্নিকাট, টমাসরা এমন তোয়াজ-তোষণ পান? ভারতের রাজনীতিকরা তাদের নিয়ে এমন দিওয়ানা হন? সবাই চেনেনও না। ভূ-রাজনীতিতে ভারতের ভ্যালু বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণে বেশি। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদারও। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাজার ভারত।

 

ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সম্ভাব্য পাল্টা শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিশাল ঘনিষ্ঠতা। এ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কোয়াডের সহযোগী দেশ অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ভূমিকা অপরিহার্য। কৌশলগত দিক থেকে ভারতের এত গুরুত্ব থাকার পরও দিল্লিতে তাদের রাষ্ট্রদূতের পদটি দুই বছর ধরে খালি রেখেছিল। বেশ কয়েকজন আমেরিকান দূত নয়াদিল্লি দূতাবাসে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর এক পর্যায়ে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটিকে নিয়োগ দিতে বার কয়েক ব্যর্থও হয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরিক যেনতেন আমলা বা কূটনীতিক নন; হাইপ্রোফাইলের রাজনীতিক। লস অ্যাঞ্জেলেসের সাবেক মেয়র। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ। সেই এরিকের নাম ভারতের ক’জনে জানে? চেনে কে? পরদেশি বাবুতে নেতিয়ে পড়েন না তারা। আবার বাগে আনতে না পারলে পেটানো, শীতে মজা করে বালিহাঁস, পাতিহাঁস, রাজহাঁস জবাই করে মাথাসহ চিবিয়ে খাওয়ার হাউজও করেন না। তাকে নিয়ে এত নিউজ ট্রিটমেন্টও হয় না। তাদের এত ভুগতেও হয় না। কাউকে ভোগাতেও হয় না। কিন্তু, ১৫ বছরে ‘ফ্যান্টাসি আক্রান্ত’ রাজনীতিতে এখানে ভোগানো-ভাগানো রাজনীতির রেশ কূটনীতিতেও। এর জেরে সামনে আরও দেখতে হতে পারে।

 

(সাংবাদিক ও কলামিসট মোস্তফা কামাল এর লেখা এ কলামটি দৈনিক দেশ রূপান্তর য দেশ রূপান্তরের অনলাইন পোর্টালে ২১ নভেম্বর, ২০২৩ এ প্রকাশিত। এখনই সময়ের পাঠকদের জন্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো।)

মন্তব্য লিখুন

জনপ্রিয় লেখা

ঢাকা-ইসলামাবাদে হাস-ব্লু দিল্লিতে বেখবর এরিক

আপডেটের সময় ১২:৫১:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ নভেম্বর ২০২৩

মোস্তফা কামাল

 

নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় পিটার ডি হাসের মতো না হলেও ইসলামাবাদে ক’দিন ধরে কর্মব্যস্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড ব্লুম। পাকিস্তানে ব্লু নামে বেশ পরিচিত তিনি। তবে, গণমাধ্যমে সংক্ষেপে ব্লুম। তার দেখাদেখি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের মধ্যেও পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে ব্যতিব্যস্ততায় বাড়বাড়ন্ত। বৈঠকসহ আতিথেয়তা নিচ্ছেন নেতাদের। দিচ্ছেনও। পাকিস্তানের পিএমএল-এনের শীর্ষ নেতা নওয়াজ শরীফের সঙ্গে লাহোরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড  ব্লুর সাম্প্রতিক বৈঠক দেশটিতে বেশ আলোচিত। গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে নওয়াজের দলের প্রস্তুতি এবং দেশটির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-পিএমএল-এন এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের আলোচনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের গুরুত্ব বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। নমুনা বা সিলসিলা বাংলাদেশের মতোই। যা হয়েছে ঢাকায় হাস ও বিভিন্ন দলের মধ্যে। বাংলাদেশে হাস-পর্বে এখন একটি কমা বা সেমিকোলন চলছে। ফুলস্টপ নয়। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ‘দিল্লি আছে আমরা আছি; আমেরিকার ভারতকে দরকার; তলে তলে পিটার হাসের মুরব্বিদের সঙ্গে আপস হয়ে গেছে’ এ বার্তার পর বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা হয়েছে। আলোচনাটি দৃশ্যত এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনুকূলে। নয়াদিল্লিতে দুদেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী টু প্লাস টু ডায়ালগের পর আলাদা ব্রিফিং করেন ভারতের বিদেশ সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ বিষয় অনুপস্থিত থাকলেও পরে কথা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে নয়াদিল্লির বক্তব্যের জবাবে ওয়াশিংটন কী বলেছিল তার কিছুটা আভাস মিলছে যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের রিপোর্টে। ১৭ নভেম্বর প্রকাশিত ওই রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়। জানা যাচ্ছে, ডায়ালগে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হয়। বৈঠকে আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা হয়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ভারতও জানিয়েছে, তারা প্রগতির বাংলাদেশ চায়।

 

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে রাজনৈতিক দলের বাইরেও সোচ্চার আছে বিশ্বের অনেক প্রভাশালী দেশ ও সংগঠন। বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কড়া নজরদারিতে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ঠিক তফসিল ঘোষণার আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে এশিয়া সাব-কন্টিনেন্টে প্রভাবশালী ডোনাল্ড লু’র চিঠিও আরেক কূটনীতি। যার সঙ্গে পাকিস্তানের ইমরান খানের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে মেলানোর একটি চর্চা চলছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে কলকাঠি নাড়ার ম্যাকানিজমে তিনি বেশ আলোচিত। সেখানে উদাহরণ হিসেবে আনা হয় ইমরান খানের পতনকে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ বা খানের সঙ্গে শেখকে মেলানোর বাস্তবতা নেই। এরপরও ইমরান খান নিজেই ডোনাল্ড লুর কারণেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে মন্তব্য করায় একটি তুলনা টানার চেষ্টা রয়েছে। কিছু জিজ্ঞাসাও ঘুরছে। একেবারেই শেষ পর্যায়ে কেন চিঠিটি দিলেন ডোনাল্ড লু? এ প্রশ্ন অগ্রাহ্য করা যায় না। চাইলে চিঠিটি কি মাসখানেক বা অন্তত ১৫ দিন আগেও দিতে পারতেন না? তা না করে কি সরকারকে বিকল্প চিন্তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলো না? নমুনাগতভাবে এতে পাকিস্তানের ছাপ।

 

অর্থনৈতিকসহ নানা সংকটে পড়া পাকিস্তান দেউলিয়াত্ব ঠেকাতে বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে বছরখানেক ধরে। খরচ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কার্যকরী মেনে এগোচ্ছে দেশটি। সরকারি অফিসে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপের পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে বিপণি বিতান বন্ধ, বিয়েসহ অন্য অনুষ্ঠানগুলো বেঁধে দেওয়া সময়ে শেষ করতে নির্দেশনা দিয়েছে শাহবাজ শরিফের মন্ত্রিসভা। এর মাধ্যমে যেন বাংলাদেশকেই মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে পাাকিস্তান। পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মতো বানাও আওয়াজ আছে দেশটির সুশীল সমাজের। সেখানে এখন লু হাওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানের রাজনীতির দিকে টেনে নেওয়ার কূটনীতির চক্কর। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক টানাপড়েনে যাচ্ছে পাকিস্তান। টানাপড়েন চলছে বাংলাদেশেও। কিন্তু, রকমফেরও বিস্তর।

 

পাকিস্তানে পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া বিপুল ঋণ নিয়ে মসনদে আসেন ইমরান খান। সৌদি আরব এবং চীনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে কোনোভাবে পাকিস্তানকে টেনে নিচ্ছিলেন। তবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তিনিও থিতু হতে পারেননি। ইমরানকে সরিয়ে গত এপ্রিলে ক্ষমতায় আসেন নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফ। তখন পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ৭ মাসে তা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। দেউলিয়ার আশঙ্কা যে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না তা ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির দর দেখেই অনুমান করা যায়। এপ্রিলে এক ডলার বিক্রি হতো ১৮০ রুপিতে। হালে আন্তঃব্যাংক বাজারে তা ঠেকেছে ২২৬। এসব সূচকে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কাতারে বিচার করা যায় না।

 

স্বাধীনতার পর প্রায় শূন্য থেকে শুরু করলেও ৫০ বছরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের সেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন এবং সৌদি আরবও এখন আর তাদের দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। পাকিস্তানের বিদ্যুৎব্যবস্থা ভয়ানক, লোডশেডিংসহ প্রায়ই গ্রিড-ফেইলিউরের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে তা ওই পর্যায়ে নয়। দুর্নীতি, পাচার, দলীয় দুর্বৃত্তায়ন বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের কাছে অনুকরণীয়। কিন্তু, রাজনীতির লু হাওয়া এখন বাংলাদেশকে পেছন থেকে টানছে পাকিস্তানের দিকে। ভূ-রাজনীতিসহ আরও কিছু বিষয় বাংলাদেশকে একদম পেয়ে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন-ভিসা রেস্ট্রিকশনের পর বিভিন্ন দেশের শ্রম অধিকার নিশ্চিতে নতুন নীতি ঘোষণা করেছে। এজন্য নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ভিসা বাধাসহ তাদের যেসব উপায় আছে সেগুলো ব্যবহারের ঘোষণা করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের উদাহরণ সরাসরি টেনে এনেছেন। ডোনাল্ড লুর চিঠিকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচন সিডিউল ঘোষণা করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার একটা শঙ্কা এমনিতেই ঘুরছিল।

 

মার্কিন পলিসি মেকাররা নিয়মতান্ত্রিক আশাবাদের আবাদ করে না। তারা প্রয়োগের জন্য পলিসি বানায়। তারা সরকারের কাছে এমন জিনিসই চেয়েছে যা দিলে সরকার আর থাকে না। গণতন্ত্রায়ন আশা করে তারা। সেইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনও চায়। যা দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। আবার সরকার প্রকাশ্যে রাগও করে না। ‘নির্বাচন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ মর্মে কথাও বাতলে দেয়। কিন্তু, ভেতরে ভেতরে ফোঁসে। নানা প্ল্যান করে। তাদের ‘এ’ ব্যর্থ হলে ‘বি’। ‘বি’ ব্যর্থ হলে ‘সি’-এর মতো, ব্যাকআপ থাকেই। প্রয়োজন মতো সেগুলো প্রয়োগ করে। তা মালুম না করে পিটার হাস চলে গেছেন বলে একদল উল্লাসে মাতে। পিটারকে পেটানো, হাসকে জবাই করে খাওয়ার হুঙ্কারদাতা মহলের বিপরীতে আরেক দলের আশা পিটার হাস তাদের ভগবান হবেন। পিটার হাস ঢাকা ছেড়ে গেছেন মানে চলে যাননি। তিনি হোস্ট কান্ট্রিতে অ্যাসাইনমেন্ট ফেল করেছেন এমন মেসেজও মেলেনি। বা তিনি ফেল করলেও তার দেশ ফেল করেছে মনে করার সময় এখনো আসেনি। বাংলাদেশ পিটার হাসদের আদর-সমাদরের লীলাভূমি। পাকিস্তানও তাই। কিন্তু, প্রতিবেশী ভারত? সেখানে কি হাস, বিউটিনিস, মজিনা, বার্নিকাট, টমাসরা এমন তোয়াজ-তোষণ পান? ভারতের রাজনীতিকরা তাদের নিয়ে এমন দিওয়ানা হন? সবাই চেনেনও না। ভূ-রাজনীতিতে ভারতের ভ্যালু বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণে বেশি। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদারও। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাজার ভারত।

 

ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সম্ভাব্য পাল্টা শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিশাল ঘনিষ্ঠতা। এ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কোয়াডের সহযোগী দেশ অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ভূমিকা অপরিহার্য। কৌশলগত দিক থেকে ভারতের এত গুরুত্ব থাকার পরও দিল্লিতে তাদের রাষ্ট্রদূতের পদটি দুই বছর ধরে খালি রেখেছিল। বেশ কয়েকজন আমেরিকান দূত নয়াদিল্লি দূতাবাসে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর এক পর্যায়ে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটিকে নিয়োগ দিতে বার কয়েক ব্যর্থও হয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরিক যেনতেন আমলা বা কূটনীতিক নন; হাইপ্রোফাইলের রাজনীতিক। লস অ্যাঞ্জেলেসের সাবেক মেয়র। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ। সেই এরিকের নাম ভারতের ক’জনে জানে? চেনে কে? পরদেশি বাবুতে নেতিয়ে পড়েন না তারা। আবার বাগে আনতে না পারলে পেটানো, শীতে মজা করে বালিহাঁস, পাতিহাঁস, রাজহাঁস জবাই করে মাথাসহ চিবিয়ে খাওয়ার হাউজও করেন না। তাকে নিয়ে এত নিউজ ট্রিটমেন্টও হয় না। তাদের এত ভুগতেও হয় না। কাউকে ভোগাতেও হয় না। কিন্তু, ১৫ বছরে ‘ফ্যান্টাসি আক্রান্ত’ রাজনীতিতে এখানে ভোগানো-ভাগানো রাজনীতির রেশ কূটনীতিতেও। এর জেরে সামনে আরও দেখতে হতে পারে।

 

(সাংবাদিক ও কলামিসট মোস্তফা কামাল এর লেখা এ কলামটি দৈনিক দেশ রূপান্তর য দেশ রূপান্তরের অনলাইন পোর্টালে ২১ নভেম্বর, ২০২৩ এ প্রকাশিত। এখনই সময়ের পাঠকদের জন্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো।)