ঢাকা ০২:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ : বাংলাদেশের সতর্কতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা

  • এখনই সময় ডেস্ক
  • আপডেটের সময় ০৭:২৬:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • 46

বাংলাদেশের সতর্কতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

 

প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এক কথায় অগ্নিগর্ভ। আর এই মিয়ানমার যুদ্ধের উত্তাপ বাংলাদেশে লেগেছে। আমরা দেখছি ওপারের গোলাগুলি, মর্টার শেল এপারের ভূখণ্ডেও এসে পড়ছে এবং ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হতাহত হওয়ার মর্মস্পর্শী ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, গত কয়েক দিনে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি, সেনাসদস্য ও বেসামরিক নাগরিকের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বাংলাদেশ সরকারের তরফে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ফের অনুপ্রবেশ এবং সেখান থেকে আসা গোলাবারুদে বাংলাদেশি হতাহতের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। 

 

মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা ও সেনাবাহিনীর দমননীতি নিয়ে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ নয়টি দেশ। বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। তাদের বর্তমান এ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে এবং বিবৃতিদাতা দেশগুলোর কাছে কূটনৈতিক পর্যায়ে বারবার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ব্যাপারে তাদের অনেকেরই কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা তেমনভাবে দৃশ্যমান হয়নি, যে ভূমিকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার পথ আরও আগেই মসৃণ করতে পারত। বাংলাদেশ মানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে এখানে শুধু আশ্রয়ই দিয়ে রাখেনি তাদের ভরণপোষণসহ নানা ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখছে তা বিশ্বদরবারে নন্দিত হলেও বাংলাদেশ যে এর যথাযথ প্রতিদান পায়নি তা সত্য। রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহায়তাসহ নানা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নানা মহল থেকে আগে যে সহযোগিতা মিলেছে এখন সে পথও অনেকটাই সংকুচিত। টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শিকড়বাকড়ও এখানে রয়েছে এমন বার্তাও সংবাদমাধ্যমের পুরোনো বিষয়। আর বর্তমানে অগ্নিগর্ভ মিয়ানমার পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য বাড়তি উপসর্গ সৃষ্টির পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

ফিরে তাকাই পেছনে। আজ থেকে ১০ বছর আগে। ২০১৪ সালের মে’র শেষে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তে পাইনছড়ির ৫২ ও ৫৩ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী এলাকায় টহল দিচ্ছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের একটি দল। প্রথামাফিক পরিচালিত ওই টহল দলের নেতৃত্বে ছিলেন নায়েব সুবেদার মিজানুর রহমান। অতর্কিতভাবে ওই দলটির ওপর গুলি চালায় সীমান্তের ওপারে থাকা মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। তাদের ব্যাপক গুলিবর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ছোট আকারের বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীদের টহল দলটি ফেরত আসে। তবে ফিরতে পারেননি নায়েব সুবেদার মিজানুর রহমান। এ নিয়ে প্রথম দিকে চুপচাপ থাকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা। ৫২ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছে অস্ত্রের গুলি লেগে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা মিজানের মোবাইল ফোন এবং মিয়ানমারের দিকে একাধিক স্থানে থাকা রক্তের ধারা প্রমাণ করে রক্তাক্ত অবস্থায় বা লাশ হয়ে যাওয়া মিজানের দেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিয়ানমারে। উচ্চ পর্যায়ের দেনদরবারের ফলে তিন-চার দিন পর মিজানের লাশ ফেরত আনা হয় বলে দেশের একটি বাংলা সংবাদপত্রের ১ জুনের সংখ্যায় খবর প্রকাশিত হয়। তার পরও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা প্রথম দফায় অস্ত্র রেখে দিয়ে কেবল লাশ ফেরত দেয়। তদুপরি বাংলাদেশের সীমান্তে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনকে (আরএসও) পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের অভিযোগ তোলে, যার প্রতিবাদ জানায় বিজিবি।

ভাগ্যের পরিহাস কিংবা কালের বিবর্তনে সেই সীমান্তের আশপাশ থেকেই সেদিনের ঘাতক মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা আজ প্রাণ বাঁচাতে গলায় বা পিঠে অস্ত্র ঝুলিয়ে দুই হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের (বিজিবি) কাছে। সব ভুলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাদের থাকাখাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বিজিবি মানবতার নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মানবতা দেখিয়েই ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও আশ্রয় দিয়েছিলেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব পাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে শরণার্থী সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আঞ্চলিক সম্প্রদায় ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সমর্থন পাওয়া যায়নি এ কথা শুরুতেই বলেছি। এদের কারণে বিঘ্নিত হয়েছে পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। অথচ বিস্ময়কর হলো, মিয়ানমার সীমান্তের ঘটনায় বর্তমান সরকারের পদক্ষেপকে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি। ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা। প্রশ্ন হচ্ছে স্বভূমত্যাগী ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার দায়ভার বাংলাদেশ বছরের পর বছর বহন করার পাশাপাশি মিয়ানমারের আজকের প্রেক্ষাপটে সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ সে দেশ থেকে পালিয়ে আসা সেনা ও সীমান্তরক্ষী সদস্যদের মর্যাদার সঙ্গে আশ্রয় দিয়ে ফের যে উদারতা দেখিয়েছে এবং বিশ্বদরবারে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিগত তিন মেয়াদের টানা আওয়ামী লীগ সরকার যে ভূমিকা পালন করেছে এ প্রেক্ষাপটে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বিষয় কি কোনোভাবেই দৃশ্যমান কিংবা প্রমাণিত?

আবারও ফিরে তাকাই পেছনে। ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর সকালে তৎকালীন বার্মার লুনথিং বা লুন্টিন বাহিনী (বর্তমানে বর্ডার গার্ড পুলিশ) নাইক্ষ্যংছড়ির বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) একটি ব্যাটালিয়নের রেজুপাড়া সীমান্তচৌকি অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে। অপ্রত্যাশিত এ আক্রমণে ওই ব্যাটালিয়নের তিনজন সদস্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। লুনথিং বাহিনী ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটে নেয়। এ ঘটনায় এলাকায় তীব্র অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনী দৃঢ় ও অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে এবং দ্রুত সামরিক ব্যবস্থার লক্ষ্যে সেনা মোতায়েন শুরু করে। এ সময় নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়।

দীর্ঘ আলোচনার পর তৎকালীন বার্মার প্রতিনিধি দল অস্ত্র লুটের কথা স্বীকার করে। পতাকা বৈঠকের পর ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বার্মার মংডু শহরের টাউনশিপ হলে অনুষ্ঠিত ফ্ল্যাগ মিটিংয়ে লুনথিং বাহিনীর অধিনায়ক লে. কর্নেল সেন লুইন বাংলাদেশ রাইফেলসের কক্সবাজার এলাকার ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের কাছে লুট করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেরত দেন। উল্লেখ্য, সীমান্তে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক মোতায়েন ও দৃঢ় মনোভাব বার্মিজ কর্তৃপক্ষকে অস্ত্র ফেরত দিতে বাধ্য করেছিল। এরপর কেটে গেছে ৩২ বছর। ইতোমধ্যে ২০১৫ সালে রামু অঞ্চলে একটি পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বৃহত্তর কক্সবাজার সমুদ্র অঞ্চলে সাবমেরিন ঘাঁটিসহ গড়ে উঠেছে নতুন নৌঘাঁটি। নতুন বিমানঘাঁটি নির্মাণসহ বিমানবাহিনীর সক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুনর্গঠিত বিজিবি পরিচালনায় সীমান্ত প্রতিরক্ষা ও ব্যবস্থাপনায়ও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এমনি প্রেক্ষাপটে সামনে চলে এসেছে মিয়ানমার সীমান্তের সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক দূরদর্শিতার আরও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রগুলোর অভিভাবক হিসেবে জাতিসংঘকে পূর্বতন পরিস্থিতিসহ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত ওয়াকিবহাল রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আলোচনার প্রস্তাব দিতে হবে। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে জাতিসংঘকে এ এলাকায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রম চালুর আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দেওয়া যেতে পারে। মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলমান বিধায় ওআইসিসহ সকল মুসলিম প্রধান দেশগুলোকেও নিয়মিত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একই সঙ্গে বেশ কিছু আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক জোটে যুক্ত। এসব জোটের মধ্যে রয়েছে আসিয়ান, এশিয়ান রিজিওনাল ফোরাম (এআরএফ), বিমসটেক ইত্যাদি। অর্থনৈতিক কারণে মিয়ানমারকে নির্ভর করতে হয় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আর্থিক ও দাতা সংস্থার ওপর। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে কূটনীতির নতুন কর্মকৌশল প্রণয়ন করে এগোনো বাঞ্ছনীয় মনে করি।

উল্লেখিত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামের সঙ্গে ব্যাপক সংযোগ স্থাপন করে সমস্যার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সমাধান অনুসন্ধানের জন্য আরও জোরালো পদেক্ষপ নিতে হবে। মনে রাখা আবশ্যক, সংঘাতসংকুল রাখাইন রাজ্যের সমস্যা একাধারে মিয়ানমারের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশেরও। চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ অনেক রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমার ঘিরে। তাই বাংলাদেশকে একক সমাধানের বদলে যুগপৎ সমাধানের পথে হাঁটা সঠিক মনে করি। আমরা আস্থা রাখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের গভীর প্রজ্ঞা নিশ্চয়ই বাংলাদেশকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথভাবে চালিত করবে। গোয়েন্দা নজরদারি সার্বক্ষণিক সতর্কতা ও সজাগ থেকে চালাতে হবে। মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যেসব সামরিক-বেসামরিক লোকের অনুপ্রবেশ বাংলাদেশে ঘটেছে তাদের ফেরত পাঠাতেও চালাতে হবে জোরদার তৎপরতা। বাংলাদেশ স্পষ্টতই প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে না বরং সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মানবিক দায়িত্ব পালন করছে, যা অন্য অনেকেই করেনি। মিয়ানমারের গৃহদাহের তাপ যাতে আমাদের জন্য উপসর্গ আরও কঠিন করে তুলতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি গভীর রাখতে হবে।

 

(অবসরপ্রাপ্ত মেজর, নিরাপত্তা-বিশ্লেষক ও গবেষক ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ এর লেখা এ বিশ্লেষণধর্মী কলামটি আজ ০৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাসশিত। এখনই সময়ের পাঠকের জন্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো।)

মন্তব্য লিখুন

জনপ্রিয় লেখা

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ : বাংলাদেশের সতর্কতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা

আপডেটের সময় ০৭:২৬:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

 

প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এক কথায় অগ্নিগর্ভ। আর এই মিয়ানমার যুদ্ধের উত্তাপ বাংলাদেশে লেগেছে। আমরা দেখছি ওপারের গোলাগুলি, মর্টার শেল এপারের ভূখণ্ডেও এসে পড়ছে এবং ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হতাহত হওয়ার মর্মস্পর্শী ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, গত কয়েক দিনে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি, সেনাসদস্য ও বেসামরিক নাগরিকের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বাংলাদেশ সরকারের তরফে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ফের অনুপ্রবেশ এবং সেখান থেকে আসা গোলাবারুদে বাংলাদেশি হতাহতের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। 

 

মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা ও সেনাবাহিনীর দমননীতি নিয়ে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ নয়টি দেশ। বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। তাদের বর্তমান এ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে এবং বিবৃতিদাতা দেশগুলোর কাছে কূটনৈতিক পর্যায়ে বারবার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ব্যাপারে তাদের অনেকেরই কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা তেমনভাবে দৃশ্যমান হয়নি, যে ভূমিকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার পথ আরও আগেই মসৃণ করতে পারত। বাংলাদেশ মানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে এখানে শুধু আশ্রয়ই দিয়ে রাখেনি তাদের ভরণপোষণসহ নানা ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখছে তা বিশ্বদরবারে নন্দিত হলেও বাংলাদেশ যে এর যথাযথ প্রতিদান পায়নি তা সত্য। রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহায়তাসহ নানা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নানা মহল থেকে আগে যে সহযোগিতা মিলেছে এখন সে পথও অনেকটাই সংকুচিত। টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শিকড়বাকড়ও এখানে রয়েছে এমন বার্তাও সংবাদমাধ্যমের পুরোনো বিষয়। আর বর্তমানে অগ্নিগর্ভ মিয়ানমার পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য বাড়তি উপসর্গ সৃষ্টির পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

ফিরে তাকাই পেছনে। আজ থেকে ১০ বছর আগে। ২০১৪ সালের মে’র শেষে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তে পাইনছড়ির ৫২ ও ৫৩ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী এলাকায় টহল দিচ্ছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের একটি দল। প্রথামাফিক পরিচালিত ওই টহল দলের নেতৃত্বে ছিলেন নায়েব সুবেদার মিজানুর রহমান। অতর্কিতভাবে ওই দলটির ওপর গুলি চালায় সীমান্তের ওপারে থাকা মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। তাদের ব্যাপক গুলিবর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ছোট আকারের বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীদের টহল দলটি ফেরত আসে। তবে ফিরতে পারেননি নায়েব সুবেদার মিজানুর রহমান। এ নিয়ে প্রথম দিকে চুপচাপ থাকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা। ৫২ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছে অস্ত্রের গুলি লেগে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা মিজানের মোবাইল ফোন এবং মিয়ানমারের দিকে একাধিক স্থানে থাকা রক্তের ধারা প্রমাণ করে রক্তাক্ত অবস্থায় বা লাশ হয়ে যাওয়া মিজানের দেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিয়ানমারে। উচ্চ পর্যায়ের দেনদরবারের ফলে তিন-চার দিন পর মিজানের লাশ ফেরত আনা হয় বলে দেশের একটি বাংলা সংবাদপত্রের ১ জুনের সংখ্যায় খবর প্রকাশিত হয়। তার পরও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা প্রথম দফায় অস্ত্র রেখে দিয়ে কেবল লাশ ফেরত দেয়। তদুপরি বাংলাদেশের সীমান্তে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনকে (আরএসও) পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের অভিযোগ তোলে, যার প্রতিবাদ জানায় বিজিবি।

ভাগ্যের পরিহাস কিংবা কালের বিবর্তনে সেই সীমান্তের আশপাশ থেকেই সেদিনের ঘাতক মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা আজ প্রাণ বাঁচাতে গলায় বা পিঠে অস্ত্র ঝুলিয়ে দুই হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের (বিজিবি) কাছে। সব ভুলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাদের থাকাখাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বিজিবি মানবতার নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মানবতা দেখিয়েই ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও আশ্রয় দিয়েছিলেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব পাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে শরণার্থী সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আঞ্চলিক সম্প্রদায় ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সমর্থন পাওয়া যায়নি এ কথা শুরুতেই বলেছি। এদের কারণে বিঘ্নিত হয়েছে পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। অথচ বিস্ময়কর হলো, মিয়ানমার সীমান্তের ঘটনায় বর্তমান সরকারের পদক্ষেপকে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি। ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা। প্রশ্ন হচ্ছে স্বভূমত্যাগী ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার দায়ভার বাংলাদেশ বছরের পর বছর বহন করার পাশাপাশি মিয়ানমারের আজকের প্রেক্ষাপটে সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ সে দেশ থেকে পালিয়ে আসা সেনা ও সীমান্তরক্ষী সদস্যদের মর্যাদার সঙ্গে আশ্রয় দিয়ে ফের যে উদারতা দেখিয়েছে এবং বিশ্বদরবারে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিগত তিন মেয়াদের টানা আওয়ামী লীগ সরকার যে ভূমিকা পালন করেছে এ প্রেক্ষাপটে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বিষয় কি কোনোভাবেই দৃশ্যমান কিংবা প্রমাণিত?

আবারও ফিরে তাকাই পেছনে। ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর সকালে তৎকালীন বার্মার লুনথিং বা লুন্টিন বাহিনী (বর্তমানে বর্ডার গার্ড পুলিশ) নাইক্ষ্যংছড়ির বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) একটি ব্যাটালিয়নের রেজুপাড়া সীমান্তচৌকি অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে। অপ্রত্যাশিত এ আক্রমণে ওই ব্যাটালিয়নের তিনজন সদস্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। লুনথিং বাহিনী ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটে নেয়। এ ঘটনায় এলাকায় তীব্র অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনী দৃঢ় ও অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে এবং দ্রুত সামরিক ব্যবস্থার লক্ষ্যে সেনা মোতায়েন শুরু করে। এ সময় নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়।

দীর্ঘ আলোচনার পর তৎকালীন বার্মার প্রতিনিধি দল অস্ত্র লুটের কথা স্বীকার করে। পতাকা বৈঠকের পর ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বার্মার মংডু শহরের টাউনশিপ হলে অনুষ্ঠিত ফ্ল্যাগ মিটিংয়ে লুনথিং বাহিনীর অধিনায়ক লে. কর্নেল সেন লুইন বাংলাদেশ রাইফেলসের কক্সবাজার এলাকার ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের কাছে লুট করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেরত দেন। উল্লেখ্য, সীমান্তে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক মোতায়েন ও দৃঢ় মনোভাব বার্মিজ কর্তৃপক্ষকে অস্ত্র ফেরত দিতে বাধ্য করেছিল। এরপর কেটে গেছে ৩২ বছর। ইতোমধ্যে ২০১৫ সালে রামু অঞ্চলে একটি পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বৃহত্তর কক্সবাজার সমুদ্র অঞ্চলে সাবমেরিন ঘাঁটিসহ গড়ে উঠেছে নতুন নৌঘাঁটি। নতুন বিমানঘাঁটি নির্মাণসহ বিমানবাহিনীর সক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুনর্গঠিত বিজিবি পরিচালনায় সীমান্ত প্রতিরক্ষা ও ব্যবস্থাপনায়ও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এমনি প্রেক্ষাপটে সামনে চলে এসেছে মিয়ানমার সীমান্তের সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক দূরদর্শিতার আরও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রগুলোর অভিভাবক হিসেবে জাতিসংঘকে পূর্বতন পরিস্থিতিসহ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত ওয়াকিবহাল রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আলোচনার প্রস্তাব দিতে হবে। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে জাতিসংঘকে এ এলাকায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রম চালুর আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দেওয়া যেতে পারে। মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলমান বিধায় ওআইসিসহ সকল মুসলিম প্রধান দেশগুলোকেও নিয়মিত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একই সঙ্গে বেশ কিছু আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক জোটে যুক্ত। এসব জোটের মধ্যে রয়েছে আসিয়ান, এশিয়ান রিজিওনাল ফোরাম (এআরএফ), বিমসটেক ইত্যাদি। অর্থনৈতিক কারণে মিয়ানমারকে নির্ভর করতে হয় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আর্থিক ও দাতা সংস্থার ওপর। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে কূটনীতির নতুন কর্মকৌশল প্রণয়ন করে এগোনো বাঞ্ছনীয় মনে করি।

উল্লেখিত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামের সঙ্গে ব্যাপক সংযোগ স্থাপন করে সমস্যার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সমাধান অনুসন্ধানের জন্য আরও জোরালো পদেক্ষপ নিতে হবে। মনে রাখা আবশ্যক, সংঘাতসংকুল রাখাইন রাজ্যের সমস্যা একাধারে মিয়ানমারের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশেরও। চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ অনেক রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমার ঘিরে। তাই বাংলাদেশকে একক সমাধানের বদলে যুগপৎ সমাধানের পথে হাঁটা সঠিক মনে করি। আমরা আস্থা রাখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের গভীর প্রজ্ঞা নিশ্চয়ই বাংলাদেশকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথভাবে চালিত করবে। গোয়েন্দা নজরদারি সার্বক্ষণিক সতর্কতা ও সজাগ থেকে চালাতে হবে। মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যেসব সামরিক-বেসামরিক লোকের অনুপ্রবেশ বাংলাদেশে ঘটেছে তাদের ফেরত পাঠাতেও চালাতে হবে জোরদার তৎপরতা। বাংলাদেশ স্পষ্টতই প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে না বরং সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মানবিক দায়িত্ব পালন করছে, যা অন্য অনেকেই করেনি। মিয়ানমারের গৃহদাহের তাপ যাতে আমাদের জন্য উপসর্গ আরও কঠিন করে তুলতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি গভীর রাখতে হবে।

 

(অবসরপ্রাপ্ত মেজর, নিরাপত্তা-বিশ্লেষক ও গবেষক ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ এর লেখা এ বিশ্লেষণধর্মী কলামটি আজ ০৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাসশিত। এখনই সময়ের পাঠকের জন্য কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো।)